ব্যাঙ্গালোর না ব্যাঙ্গালুরু সেসব হিসেব আর করিনি। পণ্ডিতেরা তো রইলই এসবের জন্য। আপাততঃ নিজেকে চার্লি চ্যাপলিনের থেকেও সড়াৎ-উস্তাদ আর সজনে ডাঁটার থেকেও রোগা চিন্তা করে ভিড় ভলভো বাসে হাত বাড়িয়ে শরীর তুলে দাঁড়ালাম যেন বাড়ীর কাজের লোক চপ্পল দিয়ে দেওয়ালে আরশোলা সেঁটে দিল। পিঠের ব্যাক-প্যাক এর গায়ে দরজা চাপ দিয়ে বন্ধ হয়ে গেল। যতই বাতানুকূল ব্যবস্থা থাকুক অফিস যাত্রীর বিভিন্ন প্রকারের ডিওর গন্ধে আবহাওয়া মোটেই অনুকুল মনে হচ্ছে না কিন্তু কী আর করা। টিভিতে ডিওর এ্যাডগুলোতে যে সমাজে যেমন ইচ্ছা চলার আমার উড়ুক্কু বেলা এমন একটা ব্যাপার ফুটে ওঠে বলাই বাহুল্য এই অবস্থায় তার কিছুমাত্র সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বরঞ্চ মনে হচ্ছে পাথরচাপা কষ্টের মতো ডিওর গন্ধে চাপা শ্বাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই প্রযুক্তি আবিষ্কার হলে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বানাতে সুবিধা হত। সে যাই হোক। ভারতের সব জায়গার লোক এই বাসে আছে। কিন্তু ভারতে যেমন বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য তেমনি এখানেও ন্যাশনাল ইন্টিগ্রিটি। তা হল সারা দেশের লোক অথচ কোন যাত্রী কোন কথা বলছে না। এর আসল কারণ অবশ্য অহিংস নীতির মতো অতটা উচ্চাঙ্গের নয়। এর আসল কারণ হল, সবাই কানে কুলুপ এঁটে আছে। কারণ ওই কুলুপের সাথে সংযুক্ত আছে মুঠোফোনের মুঠোভরা সঙ্গীত। আজ্ঞে হ্যাঁ। এই ভিড়েও সবাই প্যাঁ পোঁ রেডিও বা পছন্দের গান শুনছে। আর যারা বসতে পেয়েছে তাদেরও কানে কুলুপ আর চক্ষু স্থির এক্কেবারে অর্জুনের চক্ষু দেখার মতো তবে মুঠোফোনে।
সেদিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। একটা কথা বলে নেওয়া দরকার, ব্যাঙ্গালোরে রাস্তায় চলার সময় সবাই নাকমুখ ঢেকে চলে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে বোরখা আর হিজাব পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে তার রঙ কালোর বদলে হরেক। তাই কেউ কারুর মুখ দেখতে পায় না। ফলত সবাই আক্ষরিক অচেনা। বলা বাহুল্য আগে থেকে জানা চেনা লোকেও যদি পাশ দিয়ে চলে যায় তাহলেও চেনার উপায় নেই। পৃথিবীতে যত ধুলো আছে সব চলে এসেছে ব্যাঙ্গালোরে। যেন উপার্জনের কোন নতুন রাস্তা খুলে গেছে নিকটবর্তী কোন শহরে তাই সমস্ত প্রান্তিক মানুষেরা গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসছে। খুব বেশীদিন নেই যখন এরকম লোকে বলতে শুরু করবে যে, ভারতের যেকোন এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে যদি দেখ সবথেকে বেশি ধুলোমাখা প্লেন নামছে সেটাই চোখ বন্ধ করে বলা যায় ব্যাঙ্গালোর থেকেই আসছে। যেমন অনেককাল ধরেই হাওয়াই চটি সার সার ভীড় দেখলেই বোঝা যেত এ ট্রেন কোথায় যাচ্ছে।
দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল ওই চক্ষু স্থির মুঠোফোন। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেও এক হাত রুমাল নিয়ে ধুলোর থেকে বাঁচতে নাকে মিথ্যে চাপা দেওয়া আর অন্য হাতের চেটোয় মোবাইল শুইয়ে ধরে তার পর্দায় চোখ রেখে হেঁটে চলেছেন লালরেড্ডিসাহুমুখার্জী সকলেই। অসীম স্কিল। আমার এক বন্ধু ছিল। চটজলদি পদ্য আওড়াত। কখনও মৌলিক কখনও প্যারোডিতে। এই ছবি দেখলে নির্ঘাত এরকম একটা বলে ফেলত:
চোখ ফেটে আসে জল
এমনি করে কি শহর জুড়িয়া
চোখ খাবে দুর্বল।
চোখ থেকে ফুসফুস হুস করে সব কলকব্জা একদিন জবাব দিয়ে দেবে এমনিই এ শহরের বর্তমান অবস্থা।
পরে সময় করে এ শহরকে আরো বিস্তারিত বলা যাবে। এখন শুধু আর একটা কথা আর সেটাই খুব ভাববার কথা। একটা ব্যাপারে গোটা ব্যাঙ্গালোর এককাট্টা। আর তা হল কেউ এই শহরকে কোন অজানা কারণে নিজের ভাবেনা। কিন্তু কেন এইরকম। কারুর মনেই কি অনুরণন হয় না, সতত তোর, ব্যাঙ্গালোর।